রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৪১ পূর্বাহ্ন
অনলাইন ডেস্ক:
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নয়াভিরাম লীলাভূমি সুনামগঞ্জ। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো বহু প্রাকৃতিক ও প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ‘হাওরের রাজধানী’ খ্যাত এই জেলাজুড়ে। এসব নিদর্শন একদিকে জেলার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছে, অন্যদিকে ঐতিহ্য বহন করছে। এমনি একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন পাগলার রায়পুর বড় মসজিদ ওরফে ইয়াসিন মীর্জা মসজিদ। সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কের পাশে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনস্বরূপ দাঁড়িয়ে আছে শত বছরের পুরনো এই প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনটি। মহাশিং নদীর কূল ঘেঁষে রাজকীয় মহিমায় দাঁড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক এ মসজিদটি যে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকলা ও প্রবাহমান মহাশিং-এর এক বাকসংলগ্ন কূলে দাঁড়িয়ে যেন সভ্যতার ক্রমবিকাশ পর্যবেক্ষণ করছে মসজিদটি।
মসজিদের সামনে বিশাল ঈদগাহ ময়দান ও ঢুকতে হয় উত্তর পাশের গেট দিয়ে। তিন গম্বুজওয়ালা এ মসজিদটির অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি দুই তলাবিশিষ্ট। যতদূর জানা যায়, ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ৫ আশ্বিন শুক্রবার এই মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, কোনো ধরনের রডের ব্যবহার ছাড়াই দ্বি-তলাবিশিষ্ট এই স্থাপনাটি নির্মিত সম্পূর্ণ ইট দিয়ে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এই মসজিদটির নির্মাণকাজে মূল মিস্ত্রিসহ ‘জোগালি’রা ছিলেন ভারতীয় ও মূল স্থপতির নাম মুমিন আস্তাগার। যার পূর্বপুরুষ তাজমহলে কাজ করেছেন বলে জানা যায়। প্রায় দশ বছর ধরে মসজিদটির নির্মাণ কাজ চলে। এটি ৬৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও বারান্দাসহ ২৫ ফুট প্রস্থের গম্বুজসহ মোট উচ্চতা ৪০ ফুট। ছয়টি স্তম্ভের ওপর ছয়টি মিনার, তিনটি বিশাল গম্বুজ এবং ছোট সাইজের আরও বারোটি মিনার রয়েছে।
মসজিদের ভূমিকম্প নিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে ভূমি খনন করে বেশ মজবুত পাতের ওপর স্থাপনাটির ভিত নির্মিত। ফলে এত বছরেও মাঝারি বা শক্তিশালী কোনো ভূমিকম্পে মসজিদটিতে ফাটল ধরাতে পারেনি। এদিকে মসজিদ নির্মাণের পর এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো সংস্কারের প্রয়োজন পড়েনি। অবশ্য কেবল গম্বুজের এক জায়গায় খানিকটা লিকেজ দেখা দিয়েছিল প্রায় ত্রিশ বছর আগে। তখন গম্বুজের ওপরের দিকের কিছু পাথর পরিবর্তন করতে হয়েছিল। বিশেষজ্ঞ স্থপতিদের তত্ত্বাবধানে বেশ সতর্কতার সঙ্গে সংস্কার কাজ সম্পাদন করা হয়েছে, যাতে মূল স্থাপনার কোনোরূপ পরিবর্তন না ঘটে।
মসজিদের ভেতরকার দৃশ্য আরও বেশি নান্দনিক। মসজিদে নামাজের জন্য নির্ধারিত মূল স্থান রয়েছে দু’তলায়। মসজিদের ফ্লোর ও তার আশপাশের কারুকার্য দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। মসজিদের মিহরাব অংশে জমকালো পাথর কেটে আকর্ষণীয় ডিজাইন তোলা হয়েছে। পুরো মসজিদের চারপাশে তিন ফুট উচ্চতা পর্যন্ত যে কারুকার্য খচিত টাইলস লাগানো হয়েছে সেটাও উঁচুমানের স্থাপত্যশৈলীর ইঙ্গিত দেয়। টাইলসগুলো আনা হয়েছিল ইতালি, জার্মানি ও ইংল্যান্ড থেকে। প্রত্যেকটা প্রবেশদ্বারে পাথরখচিত খিলান মসজিদটিকে বেশ দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে।
মসজিদের নিচতলার ছাদ ঢালাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে রেলের সিøপার। ছাদ ও গম্বুজের চারপাশে পাথর খোদাই করা পাতার ডিজাইন গ্রামীণ ঐতিহ্যের জানান দেয়। মসজিদের দু’তলার মেঝেতে রয়েছে দুর্লভ শ্বেতপাথর, তার চারপাশে ব্লকে দেওয়া ব্ল্যাক স্টোন বা কালোপাথর তো আরও বেশি দুর্লভ। এগুলো আনা হয়েছে ভারতের জয়পুর থেকে। তখনকার অবিভক্ত ভারতে নদীপথের যোগাযোগই সহজ ছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই মসজিদটি নদীর কূল ঘেঁষে নির্মিত। মুসল্লিরা সবসময়ই একটা তাপমাত্রাবান্ধব অনুভূতি পান নামাজের সময়। মসজিদে ব্যবহৃত এই ধরনের পাথর একমাত্র তাজমহলে ব্যবহার করা হয়েছে।
মসজিদের মূল প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসিন মির্জা। তার ভাই ইউসুফ মির্জাও মসজিদটি নির্মাণ ভূমিকা রাখেন। ধর্মপরায়ণ এই ভ্রাতৃদ্বয় ছিলেন বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিক ও বেশ বিত্তবান।
মসজিদ নির্মাণের পেছনে মূল কারণ কী ছিল, সে সম্পর্কে লোকমুখে নানান জনশ্রুতি থাকলেও প্রতিষ্ঠাতাদের পরিবারের সূত্রে জানা যায়, ইয়াসিন মির্জার পিতা আদিল হাজী ছিলেন বেশ ধার্মিক। তখনকার সময়ে মুসলমানরা ছিলেন সংখ্যালঘু। পুরো পরগনার মধ্যে তিনিই একমাত্র হাজী ছিলেন। আদিল হাজীকে সবাই হেঁটে হজপালনকারী হিসেবে জানত।
ধর্মকর্মের প্রতি তার অগাধ মনোনিবেশ থেকে তিনি বর্তমান মসজিদের জায়গাটিতে একটি টিনশেড ঘর তৈরি করেন নামাজের জন্য। আশপাশের গ্রামের মুসলমানরাও এখানে এসে নামাজ আদায় করতেন। পরম্পরাগত ঐতিহ্যের সূত্র ধরেই ইয়াসিন মির্জার মসজিদ নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন। যে ব্যাপক স্থাপত্য নকশা তিনি হৃদয়পটে এঁকেছিলেন, তাতে মসজিদের নিচতলায় হিফজখানা আর ওপরের তলায় নামাজের স্থান নির্ধারিত ছিল। মসজিদের বাহিরের অংশকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় করার অভিপ্রায় ছিল ইয়াসিন মির্জার।
বাহিরের অপরূপ শৈলী যেন সর্বসাধারণকে মসজিদে আসতে উদ্বুদ্ধ করে। এমন প্রত্যাশা ছিল তার মন-মগজে। কিন্তু সে স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়নের মুখ দেখার আগেই তার ইন্তেকাল হলে বাহিরের নকশা আর বাস্তবায়িত হয়নি। তবে তিনি ওসিয়ত করে যান তার পরিকল্পনা অনুযায়ী মসজিদের কাজ পুরোপুরি বাস্তবায়িত করার আগে যেন তাদের কবর, এমনকি ঘরবাড়ি পর্যন্ত পাকা করা না হয়। কিন্তু সেটুকু আর হয়ে ওঠেনি। দু’ভাইয়ের কবরও আজ পর্যন্ত কাঁচা এবং বেড়া-বাউন্ডারিহীন রয়ে গেছে।