বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:২৩ পূর্বাহ্ন
ইন্দুরকানী বার্তা ডেস্ক : দুনিয়াতে ছেলেটা ছাড়া কেউ নেই আমার। তার মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে আছি। না হয় কবেই আত্মহত্যা করে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতাম। আসলে আমার মতো দুঃখী কেউ নেই।
এভাবেই কষ্টের কথাগুলো বলেছেন পিরোজপুর সদর উপজেলার ভ্যানচালক রুমা বেগম (৩৫)। ভান্ডারিয়া উপজেলায় রুমার জন্ম, এ কথা লোকমুখে শুনলেও বাবা-মা কে তা জানেন না।
ছয় বছর বয়সে তাকে পিরোজপুর শহরের রাস্তায় ফেলে যান স্বজনেরা। সেই থেকে ফুটপাতে বেড়ে ওঠা। ভিক্ষা করে জীবন চালিয়েছেন। এখন ভ্যান চালিয়ে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন এই নারী।
১০ বছর আগে তার বিয়ে হয়। বিয়ের সাড়ে সাত বছর পর তার এক ছেলেসন্তান হয়। নাম রাখেন মো. ইব্রাহিম। এখন ছেলের বয়স সাড়ে তিন বছর। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। দুই বছর আগে স্বামী অন্যত্র বিয়ে করে রুমা ও তার ছেলেকে ছেড়ে চলে যান।
আবার একা হয়ে যান রুমা। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করেন। মানুষের কটু কথা ও মনের দুঃখে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বারবার। কিন্তু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিরে আসেন। শেষে শুরু করেন ভিক্ষা। ভিক্ষা করে ফুটপাতে থেকে জীবন চলছিল তার।
ভিক্ষা করে যখন তিনবেলা খাবার জুটছিল না তখন ভ্যান চালানোর সিদ্ধান্ত নেন রুমা
ভিক্ষা করে যখন তিনবেলা খাবার জুটছিল না তখন ভ্যান চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। ছেলেকে ফুটপাতে রেখে ভ্যান চালাতে শুরু করেন। ভ্যান চালিয়ে একবেলা খাবার খান। অনেক সময় না খেয়ে থাকেন। ফুটপাতে বস্তা গায়ে দিয়ে ঘুমান। লোকে কটু কথা বললেও সহ্য করেন।
“দুনিয়ায় আমার কেউ নেই। একমাত্র ছেলেই সব। ঘরবাড়ি নেই। সারাদিন ফুটপাতে থাকি। ভ্যান চালিয়ে কোনোমতে জীবন চলে। যেদিন ভাড়া না পাই বসে থাকি। ভাড়া না পেলে না খেয়ে থাকি। গত চারদিন কোনো কাজ পাইনি। না খেয়ে থাকতে থাকতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু ছেলের জন্য খাবার কিনতে হয়। আমি পানি খেয়েও দিন পার করতে পারি।”
ছোটবেলার কথা তুলে ধরে ঢাকা পোস্টকে রুমা বেগম বলেন, শুনেছি বিচ্ছেদের পর আবার বিয়ে করেন মা-বাবা। আমাকে পিরোজপুর শহরের রাস্তায় ফেলে যান। আমি ফুটপাতে মানুষ হয়েছি। এই শহরে সবাই আমারে চিনে। ২৯ বছর ধরে আমি এই শহরের ফুটপাতে থাকছি।
কোনোদিন স্কুলে যাইনি। ছোটবেলা থেকে মানুষের লাথি-উষ্ঠা খেয়ে বড় হয়েছি। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করেছি। রাস্তায় কাজ করেছি, পানি টেনেছি, ইট ভেঙেছি, রান্না করেছি, বাসাবাড়ি পরিষ্কার করেছি, জামাকাপড় ধুয়েছি। কাজ শেষে ছালা গায়ে দিয়ে ফুটপাতে ঘুমাইছি। মাথার নিচে ইট দিয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে দাগ বসে গেছে আমার।
“দু’মুঠো ভাতের জন্য আমি সারাজীবন কষ্ট করেছি। ছোটকালে যখন মানুষের কাছে ভাত চাইতাম তখন পানির বালতি ধরিয়ে দিত। পানি ভরে দিলে খাবার দিত। চায়ের দোকানের কেটলিতে পানি ভরে দিলে রুটি দিত। অনেক সময় দোকানে খাবার চাইলে গরম পানি মারত। এতে শরীর ঝলসে যায় কয়েকবার।”
একসময় মানুষের কাছে ভাত না চেয়ে ফেন চাইতাম। একটু খাইয়ে অনেক বেশি কাজ করাতে দিত তারা। না করলে মারত। আমার শরীরের অনেক স্থানে মাইরের আঘাত আছে। আমি কাউরে কষ্টের কথা বলতে পারিনি। ভ্যান চালিয়ে আমার আর ছেলের জীবন চলে না। খুব কষ্ট হয়। এজন্য না খেয়ে থাকতে হয়।
রুমাকে ছয় বছর বয়সে পিরোজপুর শহরের রাস্তায় ফেলে যান স্বজনেরা
রুমা বেগম বলেন, বোঝা বইতে বইতে আমি এখন অনেকটা পঙ্গু। বসলে উঠতে পারি না। ঠিকমতো গাড়ি চালাতে পারি না। গাড়িতে বোঝা ওঠাতে কষ্ট হয়। তবু টানি। আমর বাঁ পাশ অবশ। ছেলের জন্য কষ্ট করছি। না হয় কবেই আত্মহত্যা করতাম। ছেলেটাকে কার কাছে রেখে যাব। এজন্য এখনো মানুষের লাথি-উষ্ঠা খাই। ভ্যান চালাই, ফুটপাতে ঘুমাই বলে মানুষে বলে নষ্টা। অবশ্য এসব আমার সয়ে গেছে। তাদের কথা শুনতে শুনতে আমি বোবা হয়ে গেছি।
সরকার অনেক মানুষকে ঘর দেয়। আমার তো কিছুই নেই। যদি আমার দিকে একটু তাকায়, আমাকে একটা ঘর বানিয়ে দেয়; তাহলে শেষ জীবনটা কেটে যেত। একটা ঘরের আকুতি আমার।
পিরোজপুর জেলা মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সালমা রহমান হ্যাপি বলেন, আমরা মহিলা পরিষদ সারা বছর অবহেলিত এবং নির্যাতিত নারীদের নিয়ে কাজ করি। যখনই খোঁজ পাই তখনই অসহায় নারীদের কাছে ছুটে যাই। সহযোগিতা করার চেষ্টা করি।
তিনি বলেন, রুমা বেগম ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে তাকে সহযোগিতা করার চিন্তা করছি আমরা। তার পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিভিন্ন সংগঠনকে অনুরোধ করেছি আমরা।